আধুনিক টেলিস্কোপের সাথে গ্যালিলিওর নাম ওতপ্রতভাবে জড়িত। আজ আমরা গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র যে টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করছি তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন গ্যালিলিও।
ইতালির পিসা নগরী। সময় ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ। শহরের গির্জায় বসে এক তরুণ ছাত্র তন্ময় হয়ে দেখছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত একটি লণ্ঠনের দুলুনি। ডাইনে-বাঁয়ে এবং বাঁয়ে-ডাইনে লণ্ঠনটি যাওয়া-আসা করছে কখনো কম, কখনো একটু বেশি দূর পর্যন্ত। সরলরেখায় নয়, তার যাওয়া-আসার পথটি অদশ্য এক বৃত্তচাপ। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দুলুনির ব্যবধান কমবেশি যাই হোক, একেকটি আবর্তনের সময় একই লাগছে। এটি মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তরুণটির কব্জির নাড়ি টিপে তার স্পন্দনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখল, যা ভেবেছে ঠিক তাই। দুলুনির সময়ে এতটুকু হেরফের হচ্ছে না। প্রতিদিনি কত লোকই তো দেখছে ওই দোলন, কিন্তু কারও মাথায় খেলেনি সময়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের ওই বৈশিষ্ট্য। ওই মাথাটি আসাধারণ বলেই বৈজ্ঞানিক সত্যটি মুহূর্তে ধরা পড়ে গিয়েছিল সেই তরুণের চোখে। তরুণটি আর কেউ নন, পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলি। একটি দৈনন্দিন ঘটনা থেকে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন পেন্ডুলামের তত্ত্ব। গ্যালিলিওর বয়স তখন মাত্র ১৭। ডাক্তারি পড়ছেন পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ডাক্তারি বইয়ে মন নেই, তার আগ্রহের মূল কেন্দ্র তখন গণিত। ততদিনে তার দেখা হয়ে গেছে তাসকেনির গ্র্যান্ড ডিউক এবং প্রশাসকের সভা গণিতজ্ঞ অস্তিলিও রিকির সঙ্গে। শোনা যায়, রিকি যখন গণিতের ক্লাস নিতেন, গ্যালিলিও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে রাখতেন সেই বক্তৃতায়। কারণ, তিনি চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র গণিত তার বিষয় নয়। রিকির নজরে পড়তে দেরি অবশ্য হয়নি গ্যালিলিওর। রিকিও প্রাণ ঢেলে শেখান প্রতিভাধর নতুন ছাত্রটিকে। গণিতের এ জ্ঞান, পরবর্তীকালে ‘মেকানিকস’ অর্থাৎ গতিবিদ্যা তত্ত্ব রচনায় বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। পদার্থ বিজ্ঞানে আধুনিক গণিতবিদ্যারও জনক গ্যালিলিও গ্যালিলি। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং নবজাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক তিনি। পিসা নগরীতেই ১৫৬৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্যলিলিওর জন্ম। এক সময় ধনী এবং অভিজাত হিসেবে পরিচিত ছিল তাঁদের বংশের। ১৫ শতকের মাঝামাঝি ওই বংশের এক নামী পুরুষ ছিলেন গ্যালিলিও বোনাইউতি। তিনি ছিলেন একধারে চিকিৎসক এবং প্রশাসক। গ্যালিলিও গ্যালিলির যখন জন্ম হয়, বংশের সেই গৌরব তখন আর নেই। কিন্তু আভিজাত্যের পলিশটুকু তখনো ছিল। গ্যালিলিওর বাবা ভিনসেনজিও ছিলেন ফ্লোরেন্সের রাজসভার সঙ্গীতকার। আবার গণিতত্ত্বে দক্ষতা ছিল তার। মেলামেশা ছিল উচ্চমার্গীয় ডিউক এবং প্রিন্সদের সঙ্গে। ছেলেবেলা থেকেই গ্যালিলিওর আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে, সম্ভবত বাবার কাছ থেকেই তা পাওয়া ‘লিউট’ নামক একটি যন্ত্র বাজানোয় পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। গ্যালিলিওর আজীবন সঙ্গী ছিল লিউট-আইনস্টাইনের যেমন বেহালা অথবা সত্যেন বসুর এস্রাজ।
১১ বছর বয়স পর্যন্ত গ্যালিলিওর পড়াশোনা বাড়িতেই, প্রধানত বাবার কাছে। কখনো বা গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। এরপর ১৫৭৫ সালে প্রথাগত শিক্ষার জন্য বালক গ্যালিলিওকে পাঠানো হয় ফ্লোরেন্স থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এক মনাস্টেরিতে। ৪ বছর সেখানে পড়াশোনার পর ১৫ বছর বয়সে গ্যালিলিওকে ওই মঠের শিক্ষানবিশ যাজক করে নেয়া হয়, যা তাঁর বাবার একেবারেই পছন্দ ছিল না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি যথেষ্ট বিরাগ ছিল তার। চোখের অসুখের জন্য ডাক্তার দেখানোর নাম করে তিনি যাজকদের খপ্পর থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন। চোখের অসুখটা অবশ্য বানানো ছিল না। কিন্তু ভিনসেনজিও ছেলেকে আর সেই মঠে ফেরত পাঠাননি। তিনি চেয়েছিলেন, তার নামী এক পূর্বপুরুষের মতোই ছেলে চিকিৎসক হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। তাই গ্যালিলিওকে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং সূর্য ও গ্রহগুলো তাকে আবর্তন করে চলেছে। টলেমির এ পৃথিবী কেন্দ্রিক তত্ত্ব যে ভুল, তথ্য ও যুক্তি দিয়ে কোপারনিকাস তা প্রমাণ করেন, যার কথা লেখা আছে তার বিখ্যাত ‘ডি রেভলিউশনারস’ গ্রন্থে।